চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ইতিহাসের ধারণা থাকলেও সেরকম কোন নিদর্শন খুজে পাওয়া যায়নি। সীতাকুন্ডের পাহাড়ী এলাকায় প্রস্তরযুগের কিছু অস্ত্রের নমুনা পাওয়া গেছে। প্রাচীন গ্রিক ও মিশরীয় ভৌগলিকদের বর্ণনায় চট্টগ্রামের কিছু স্থানের উল্লেখ পাওযা যায়। ইতিহাসবেত্তা ড. নলিনীকান্ত ভট্টাচার্য প্লিনিরপেরিপ্লাসের ক্রিসকে চট্টগ্রামের দ্বীপ সন্দীপ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আবর ল্যাসেনতো পেন্টাপোলিসকেই চট্টগ্রাম মনে করেন।
পালবংশের শাসনামলে আরব পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরকে সমন্দর নামে চিনতো বলে জানা যায়। ধর্মপালের শাসনামলে চট্টগ্রাম তার অধীনে ছিল।
দ্বিতীয় সহস্রাব্দে
দশম ও একাদশ শতকে দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে ও আরাকানে চন্দ্ররাজারা ছিল চট্টগ্রামের শাসক। আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা-তাইং-সন্দয়া ৯৫৩ সালে বাংলা অভিযানে বের হন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি চট্টগ্রাম অতিক্রম না করে সীতাকুণ্ডে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। এর শিলালিপিতে লেখা হয় চেৎ-ত-গৌঙ্গ যার অর্থ হলো ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ’। আরাকানী পুঁথি থেকে জানা যায় এরপর থেকে এই এলাকার নাম হয় চেত্তগৌং। কালক্রমে চেত্তগৌং থেকে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং নামের উৎপত্তি। চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ পূর্ববঙ্গ রাজা শ্রীচন্দ্রের শাসনেই থেকে যায়। একাদশ শতকে দাক্ষিনাত্যের দিগ্বিজয়ভ রাজা রাগন্দ্র চোল এ অঞ্চল দখল করেন। এর পরের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। তবে ঔ সময়ে চট্টগ্রামের প্রধান ধর্ম ছিল বৌদ্ধ ধর্ম। তিব্বতীয় পূথি অনুসারে সে সময় চট্টগ্রামে পন্ডিত বিহার নামে একটি বিখ্যাত বিহার ছিল।
মুসলিম শাসনামল
চন্দ্রবংশের পর লালবংশ এবং এরপর কয়েকজন রাজার কথা কিছু ঐতিহাসিক উল্লেখ করলেও ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশের মতে ১৩৩৮ সালে সুলতান ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ-এর চট্টগ্রাম বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইতিহাস অস্পস্ট। এ বিজয়ের ফলে চট্টগ্রাম স্বাধীন সোনারগাঁও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ইবনে বতুতার বিবরণীতে চট্টগ্রাম
সেসময়ে ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন -“বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমূদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। …আমি সোদওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।” ১৩৫২-৫৩ সালে ফকরুদ্দীন মোবারক শাহ এর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে হত্যা করে বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার মসনদ দখল করলে চট্টগ্রামও তার করতলগত হয়। তার সময়ে চট্টগ্রাম বাংলা প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর হিন্দুরাজা গণেশ ও তার বংশধররা চট্টগ্রাম শাসন করে। এরপরে বাংলায় হাবমী বংশ প্রতিষ্ঠা হয়।
চীনা পর্যটকের বিবরণীতে চট্টগ্রাম
পনের শতকের চট্টগ্রামের একটি বিবরণ পাওয়া যায় চীনা পরিব্রাজক ফেই-শিন এর ‘’শিং-ছা-শ্যাং-লান’’ নামের ভ্রমণ গ্রণ্থে। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ-এর আমলে চীনা দূতদের মধ্যে ফেই-শিন ছিলেন। ১৪৩৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি উক্ত বইতে চট্টগ্রাম সম্পর্কিত বর্ণনা দেন :
বাতাস অনুকূল থাকলে সুমাত্রা থেকে এই দেশে কুড়ি দিনে পৌঁছানো যায়। এ দেশ (চীনের) পশ্চিমে অবস্থিত ভারতবর্ষ নামে দেশটির অন্তর্গত। সম্রাট যুং-লোর রাজত্বের ত্রয়োদশ বর্ষে (১৪১৫ খ্রি.) সম্রাট দুইবার আদেশ জারি করার পরে প্রতিনিধি হৌ-শিয়েনএক বিরাট নৌবহর আর এবং অনেক লোকজন নিয়ে (বাংলার) রাজা, রানি এবং অমাত্যদের কাছে তাঁর (চীন সম্রাটের) উপহার পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হলেন। এই দেশটির উপসাগরের কূলে একটি সামুদ্রিক বন্দর আছে তার নাম চা-টি-কিয়াং। এখানে কোন কোন শুল্ক আদায় করা হয়। রাজা যখন শুনলেন আমাদের জাহাজ সেখানে পৌছেছে, তিনি পতাকা ও অন্যান্য উপহার সমেত উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারীদের সেখানে পাঠালেন। হাজারেরও বেশি ঘোড়া ও মানুষ বন্দরে এসেহাজির হল। ষোলটি পর্ব অতিক্রম করে আমরা সুও-না-উল-কিয়াং (সোনারগাঁও)-তে পৌঁছলাম। এই জায়গাটি দেওয়াল দিয়ে ঘেরা; এখানে পুকুর, রাস্তাঘাট ও বাজার আছে, সেখানে সবরকম জিনিসের বেচাকেনা চলে। এখানে রাজার লোকেরা হাতি, ঘোড়া, প্রভৃতি নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করলো। কিন্তু ১৪৯২ সালে সুলতান হোসেন শাহ বাংলা সুলতান হোন। কিন্তু চট্টগ্রামের দখল নিয়ে তাকে ১৪১৩-১৪১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত রাজা ধনমানিক্যের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ-এর রাজত্ব উত্তর আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার সময়ে উত্তর চট্টগ্রামের নায়েব পরাগল খানের পুত্র ছুটি খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের একটি পর্বের বঙ্গানুবাদ করেন।
পর্তুগিজদের আগমন ও বন্দরের কতৃত্ব লাভ
১৫১৭ সাল থেকে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। বাণিজ্যের চেয়ে তাদের মধ্যে জলদস্যুতার বিষয়টি প্রবল ছিল। সুলতান প্রবলভাবে তাদের দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করবে শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হোসেন শাহ পর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। তখন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। একই সঙ্গে তাদেরকে বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৫৩৮ সালে শের শাহ-র সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করে। তবে, ১৫৮০ পর্যন্ত আফগান শাসনামলে সবসময় ত্রিপুরা আর আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে।
আরাকানী শাসন
১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। তবে, পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম এ সময় খুবই বৃদ্ধি পায়। বাধ্য হয়ে আরাকান রাজা ১৬০৩ ও ১৬০৭ সালে শক্ত হাতে পর্তুগিজদের দমন করেন। ১৬০৭ সালেই ফরাসি পরিব্রাজক ডি লাভাল চট্টগ্রাম সফর করেন।তবে সে সময় পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস সন্দীপ দখল করে রাখে। পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি ম্যানরিক ১৬৩০-১৬৩৪ সময়কালে চট্টগ্রামে উপস্থিতকালে চট্টগ্রাম শাসক আলামেনের প্রসংসা করে যান। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগলদের হস্তগত হয়।
চট্টগ্রামে আরাকানী শাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম আরাকানীদের কাছ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করে। জমির পরিমাণে মঘী কানির ব্যবহার এখনো চট্টগ্রামে রয়েছে। মঘী সনের ব্যবহারও দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। সে সময়ে আরাকানে মুসলিম জনবসতি বাড়ে। আরকান রাজসভায় কবি আলাওলের মতো বাংলা কবিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়। পদ্মাবতী আলাওলের অন্যতম কাব্য।
মোগল আমল
চট্টগ্রামে মোগল ফৌজদারগণ
১৬৬৬ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম দখলের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। যুদ্ধে পর্তুগিজরা বিশ্বাসঘাতকতা করলে আরাকানীরা পরাজিত হয়। মোগল সেনাপতি উম্মদ খান চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। আরাকানীরা চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হলেও প্রায়শ চট্টগ্রামে হামলা করতো। টমাস প্রোট নামে একজন ইংরেজ সেই সময় আরাকানীদের সঙ্গে যোগ দিলেও শেষ পর্যন্ত তাদের হাতেই মারা পড়ে। ১৬৮৬ সালে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক ও ১৮৬৮ সালে কাপ্তেন হিথ চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হোন। ১৭১০ সাল পর্যন্ত হাজারী মনসবদাররাই ফৌজদার নিযুক্ত হলেও এরপর থেকে নায়েবরাই শাসনকার্য চালাতে থাকেন। ১৭২৫ সালে আরাকানীরা একেবারে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে পড়ে। তবে ৩০ হাজার মগ সৈন্য সেবারও সফল হতে পারে নি। চট্টগ্রাম দখলের পর মোগলরা পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলে ঢোকার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৭১৩ সালে সমতলের বাসিন্দাদের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য চাকমা সর্দার জালাল খান চুক্তি করেন। মোগলদের শাসনামলে চট্টগ্রামে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন ও বন্দর দখলের জন্য ইউরোপীয় সম্প্রদায় ছলে-বলে-কৌশলে চেষ্টা চালাতে থাকে।
মোগল আমলে চট্টগ্রামের ফৌজদারদের সহায়তা করার জন্য শাসন কাজে একজন বকশি এবং রাজস্ব কাজে একজন দেওয়ান নিয়োগ করা হত। মোগল আমলে চট্টগ্রামের ফৌজদারদের বকশি: বকশি-রা হলেনঃ মির্জা খলিল (১৬৬৬-১৬৬৮), মির্জা মুজাফফর খান (১৬৬৯-১৬৭০), মির মোহাম্মদ হোসেন (১৬৭২-১৬৭৯), মির জাফর (১৬৮০-১৬৮৬ ?) মোহাম্মদ হোসেন (১৬৮৭ ? – ১৬৮৮), মোহাম্মদ নইম (১৬৮৯-১৬৯৯), নূরুদ্দিন মোহাম্মদ (১৭০৪-১৭১৩)। ঐ সময়ে চট্টগ্রামের ফৌজদারদের অধীনে কার্যরত দেওয়ানরা হচ্ছেনঃ নরসিংহ রায় (১৬৬৬-১৬৬৮), ভগুনি দাস (১৬৬৯-১৬৭৭), হোসেন কলি খান ১৬৭৮-১৬৭৮) জয়নুল আবেদিন (১৬৮০-১৬৮৭), মোহাম্মদ খান (১৬৮৮-১৬৯৯), সোলতান মোহাম্মদ (১৭০৪-১৭০৬), মির আমজাদ (১৭০৭-১৭০৮), মনিরাম (১৭১১-১৭২৮), সুয়াজান পেশকার (প্রতিনিধি-মনিরাম) (১৭৩৬), মোকেম সিংহ (১৭৩৬), বাঙ্গালি লাল (১৭৩৭-৩৮), বরুণ দত্ত (১৭৩৯), লক্ষ্মীনারায়ন (১৭৪০-৪১), হমাসিংহ (১৭৪২-১৭৫১), চৈতন কিষণ (১৭৫২-১৭৫৩), বাঙ্গালি লাল (১৭৫৭-৫৮), রাম সিংহ (১৭৫৮-১৭৬০)।
১৬৭০ ও ১৭১০ সালে আরাকানীরা চট্টগ্রামের সীমান্তে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৭২৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার মগ সৈন্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে চট্টগ্রামবাসীকে বিপদাপন্ন করে ফেলে। তবে শেষপর্যন্ত মোগলরা তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই সময় মোগলদের কারণে ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দর কোনভাবেই দখল করতে পারে নি। মোগলরা পার্বত্য এলাকার অদিবাসীদের সঙ্গে, বিশেষ করে চাকমা সম্প্রদায়ের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সদ্ভাব বজায় রাখে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় চট্টগ্রামে ইংরেজদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়। তারা এমনকী চট্টগ্রাম বন্দর তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য নবাব মীর জাফর আলীর ওপর চাপ প্রয়োহ করে। সফল না হয়ে পরে তারব মীর কাশিমকে একটি গোপন চুক্তির আওতায় নবাব বানায়। চুক্তি অনুসারে ১৭৬১ সালে মীর কাশিম বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ইংরেজদের দিয়ে দেয়। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খাঁ সরকারীভাবে ভেরেলস্ট-এর হাতে চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। ২৯ মার্চব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে ৩৪ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনী বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের খবর চট্টগ্রামে এসে পৌঁছালে ২, ৩ ও ৪ নম্বর কোম্পানির সৈন্যরাও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১৮৫৭ সালের ১৮ ণভেম্বর সিপাহীরা কারাগারের বন্দীদের মুক্ত করার মাধ্যমে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটায়। হাবিলদার রজব আলী ও সিপাহী জামাল খান এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। সিপাহীরা কোন ইউরোপীয় বা স্থানীয় নাগরিকের কোন ক্ষতি করে নি। ১৯ তারিখে তারা চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। উদ্দশ্য ছির ঢাকার বিদ্রোহী ৭৩ নম্বর কোম্পানির সঙ্গে যোগ দেওয়া। এখবর পেয়ে ইংরেজ কোপানি কুমিল্লার কোষাগারের ঠাকা ঢাকায় সরিয়ে নওয়া, নৌবাহিনী তলব করা সহ নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২২ নভেম্বর ঢাকার বিদ্রোহীরা পরাজয় স্বীকার করে। এখবর পেয়ে চট্টগ্রামের সিপাহীরা উদয়পুরের দিকে যেতে চেষ্টা করে। ইংরেজ কোম্পানির অনুরোধে ত্রিপুরা রাজ তাদের বাঁধা দেন। এভাবে বিভিন্ন স্থানে লড়াই সংগ্রাম এবং রসদের অভাবে বিদ্রোহীরা অনেকখানি কাবু হয়ে পড়ে। শেষ ১৮৫৮ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের মনিপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াই-এ চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের অবসান হয়। বিভিন্ন লড়াই-এ মোট ২০৬ জন সিপাহী শহীদ হোন ও বাকীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। সিপাহীরা যে ২০২ জন বন্দীকে মুক্ত করে তার ১৬৭ জনই পরে আবার বন্দী হয়। ইংরেজরা মোট ৫জন সিপাহীকে বন্দী করে যাদের একজনের মৃত্যুদন্ড ও বাকীদের নানান মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৮৫৭ -এর চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই বিদ্রোহে দমনে ইংরেজ বাহিনী স্থানীয় জমিদার বা অন্য কারো কোন সহযোগিতা পায় নি। চট্টগ্রামবাসী সেবার প্রমাণ করেছিল তারা বস্তুত রাজাকার নয়।
১৮৯২, ১৮৯৬ ও ১৯০১ সালে চট্টগ্রামকে বাংলা থেকে পৃথক করে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় ইংরেজ সরকার। এই প্রচেষ্টার প্রতিরোধে চট্টগ্রামে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটি ১৮৯৫-৯৬ সালে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন জোরদার ও ১৯০২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা। ১৯০২ সালের ২৯ ও ৩০ মার্চ প্যারেড ময়দান-এ সংস্থার প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন যাত্রা মোহন সেন।
বঙ্গভঙ্গ
চট্টগ্রাম নামের উৎস
বৈচিত্রময়ী চট্টগ্রামের নামের কারণও বৈচিত্রে ভরা। খ্রিষ্টীয় দশক শতকের আগে চট্টগ্রাম নামের অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নামের কোন উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পন্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এখানকার শাসক গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বহু নামে খ্যাত করেছিলেন। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, শ্রীচট্টল, চাটিগাঁ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু কোন নামের সঙ্গে পাঁচজন একমত হন না। সে সব নাম থেকে চট্টগ্রামের নাম উৎপত্তির সম্ভাব্য ও চট্টগ্রামের নামের সঙ্গে ধ্বনিমিলযুক্ত তেরটি নামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।