খালিদ সাহেব সিগারেট এ টান দিতে দিতে বাসার কলিং বেল চাপেন।
সাবিহা : (খালিদ সাহেবের স্ত্রী) এই ছোটলোকের বাচ্চা রাত্রিবেলা মাছ এনেছ কেন,বলি কুটবে কে?
খালিদ : (ভয়ে কণ্ঠস্বর নীচু করে) সরি ভুল হয়ে গেছে।
সাবিহা : সরি বলে বাঁচতে পারবেনা, ভালো চাইলে মাছ কুট। খালিদ সাহেব চোখেরজল ফেলে আর মাছ কুটে। খালিদ সাহেব ও তার স্ত্রী সাবিহা একই কলেজের শিক্ষক। বিয়ের পনের বছর হলো, এতদিনের মধ্যে সাবিহা খালিদ সাহেবকে কোনদিন শান্তি দেয়নি। খালিদ সরল মনের মানুষ, স্ত্রীর দেওয়া শত কষ্ট উপেক্ষা করে স্ত্রীকে সুখী করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন, স্ত্রীকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন বিশ্বাস করেন।
খালিদ : রাত ১১:০০টা বাজে লতিফ সাহেব আপনারা কথা বলেন আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে, সাবিহা আমি ঘুমাতে গেলাম।
সাবিহা : দেখো ইভার যেন ঘুম না ভাঙে। (ইভা তাদের ৮বছরের মেয়ে)
খালিদ : শুভরাত্রি, লতিফ সাহেব।
লতিফ : শুভরাত্রি। লতিফ সাহেবও একই কলেজে শিক্ষকতা করেন।খালিদ সাহেবের অনেক জুনিয়র। খালিদ তাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন, বিশ্বাস করেন । প্রতিরাতে খালিদ সাহেবের বাসায় এসে আড্ডা দেন, প্রতিদিনের মতো আজও বাসায় এসেছে।
আবিদ : মা আমার ঘুম পাচ্ছে।
সাবিহা : ওকে ঘুমাও। কিছুক্ষণের মধ্যে আবিদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
লতিফ : একবার দেখে আস জান, খালিদ ঘুমিয়েছে কিনা।
সাবিহা : (দেখে এসে)হ্যা বজ্জাৎটা ঘুমিয়েছে। লতিফ সাহেব সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে
লতিফ : তুমি অনেক সুন্দরি। আমার বউ একটা বাজে, ওকে একদম ভালো লাগেনা।
সাবিহা : আমার স্বামীটাও বদমাইশ। ওকে আমার একদম সহ্য হয়না। রাত ১:০০টা বাজে লতিফ ক্লান্ত হয়ে গেল।
লতিফ : জান আজ আসি।
সাবিহা : আর কিছুক্ষণ থাক জান। লতিফ সাবিহার ওষ্ঠ দংশন করে।
সাবিহা : এবার ছাড়।
লতিফ : এখন যেতে ইচ্ছে করছেনা।
সাবিহা : লক্ষীটি এবার ছেড়ে দাও।অনেক রাত হয়েছে। কালকে এস।
লতিফ : ওকে। সাবিহা খালিদের পাশে শুয়ে আছে, রাত ২:০০টা বাজে,খালিদ ঘুমের ঘোরে সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে।
সাবিহা : (ধমক দিয়ে)ছাড় কোলবালিশ নাও।
খালিদ : জীবন্ত কোলবালিশ রেখে কেউ প্রাণহীন কোলবালিশ ধরে বলেই জোড় করে আরও বেশি জড়িয়ে ধরে।সাবিহা কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়ে। লতিফ বাসার দরজায় জোড়ে জোড়ে লাথি দেয়। সনিয়া লতিফ সাহেবের স্ত্রী ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে। সনিয়া ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে
লতিফ : দরজা খুলতে দেরী করেছিস কেন (বলেই এক লাথিতে সনিয়াকে মেঝেতে ফেলে দেয়)
সনিয়া : (অতিকষ্টে উঠে) টেবিলে খাবার দিয়েছি খেয়ে নিন। লতিফ খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সনিয়া অপেক্ষা করছিল লতিফের সাথে খাবে, লতিফ ডাক না দেওয়ায় কষ্ট পেয়ে সনিয়া না খেয়েই শুয়ে পড়ে, কিন্তু দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা, উঠে গিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে থাকে, দুগাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। আকাশের প্রতিটি তারকা তার কষ্টগুলি অনুভব করে। সাবিহা সকালে ভিজা চুলে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই খালিদ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে গোলাপ পড়িয়ে দেয়।
খালিদ : তুমি গোলাপের চেয়েও সুন্দর।
সাবিহা : (ধমক দিয়ে)ছাড় ঢং দেখাবে না। খালিদ চোখের জল আড়াল করে সাবিহার কপালে আলতো করে চুমো খায়।
সাবিহা : কাজের লোকও এত ভাত খায়না।খাওয়া দেখলে গা জলে। খালিদ কথা না বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা স্বস্তি পায়। সিগারেটে টান দিতে দিতে কলেজে যায়।
লতিফ : (কলেজের বারান্দায়) নীল শাড়ীতে তুমাকে পরীর মতো লাগছে, আকাশ থেকে যেন এইমাত্র মাটিতে নেমেছে।
সাবিহা : চুপ,কেউ শুনে ফেলবে। লতিফ:ওকে সন্ধ্যায় দেখা হবে। লতিফ ও সাবিহার পরকীয়া প্রেম, আসঙ্গলিপ্সা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীর হয়। সন্ধ্যায় লতিফ সাবিহার বাসার উদ্দেশ্য বের হচ্ছে হঠাৎ লিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে। লিয়া লতিফের পাঁচ বছরের মেয়ে।
লিয়া : আব্বু আমিও তুমার সাথে যাবো। তুমি প্রতিদিন একা একা বেড়াতে যাও আর আমাকে নিয়ে যাওনা। তুমি অনেক পচা আব্বু।
লতিফ : সনিয়া তুই লিয়াকে ব্যবহার করে আমায় বাধা দিচ্ছিস, তুর সাহসতো কম নয়। (ধাক্কা দিয়ে লিয়াকে সনিয়ার কাছে ফেলে দিয়ে লতিফ চলে যায়। ১৮বছর পর বছর দুএক হলো খালিদ চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে। ইদানীং খালিদ সাহেবের শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। চৈত্রের দুপুর, রৌদ্রের খড়তাপে উত্তপ্ত চারদিক। এমন সময় খালিদ সাহেব চেয়ার থেকে ঘরের মেঝেতে পড়ে গেলেন।অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরছেনা,হাসপাতালে দুইঘন্টা চিকিৎসার পর জ্ঞান ফিরে। ডাক্তার অনেক টেস্ট করাতে বললেন।
ডাক্তার : (রিপোর্ট দেখে) আপনি কি রোগীর স্ত্রী।
সাবিহা : হ্যা, আমাকে সব বলেন।
ডাক্তার : কিভাবে যে বলি, রোগীর অবস্থা ভালো না, বড়জোর মাস দুএক বাঁচবে। রোগীর শেষ ইচ্ছেগুলি পূরণ করেন। রিপোর্ট খারাপ শুনে সাবিহার অত্যাচার আরও বেড়ে গেল।ছেলেমেয়ে দুটো তার মতো করে গড়ে তুলেছে। খালিদ সাহেবের কষ্ট বুঝেনা।
সাবিহা : তুমার এত খারাপ রোগ হয় কেন। কোন খাওয়ার নিয়ম নাই কোন কিছুতে নিয়ম নাই অপদার্থ কোথাকার। আমার জীবনটা অসহ্য করে তুলেছে,আমি আর পারছিনা।
আবিদ : আমার মা ভালো দেখে তোমাকে এখনো ঘরে রেখেছে,এত বড় রোগ আর কেউ হলে লাথি দিয়ে বের করে দিত। খালিদ সাহেবের চোখ দিয়ে আর জল আসেনা,কষ্ট পেয়ে পেয়ে মানুষটা কেমনযেন পাথরের মতো হয়ে গেছে। খালিদ সাহেব হাসপাতালে ভর্তি । তার ভাইবোন তাকে দেখতে আসে।
সাবিহা : রানি (খালিদের বোন) তোমরা তোমাদের ভাইয়ের সেবা কর খালিদ তোমাদের মানুষ আমার কিছুনা। রানি উত্তর দেয়না, এমনিতে ভাই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে, এসময় এই বিবেকহীনের সাথে তার কথা বলার ইচ্ছে হয়না। সাবিহা হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে যায়। কলেজে যায়। ভালোই আছে। রানি ও খোকন (খোকন খালিদের ভাই) খালিদের সাথে হাসপাতালে থাকে ও ভাইয়ের সেবা করে। আজ খালিদের অবস্থা খুব খারাপ। রানি সাবিহাকে ফোন দেয়। সাবিহা ডাক্তারের দেয়া সময় হিসেব করে বুঝে এখনি মরার সময়। তাই সবার সামনে নিজেকে ভালো জানাতে হাসপাতালে চলে আসে।
খালিদ : সাবিহা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমায় ক্ষমা করে দিও। বলেই খালিদ সাহেব চোখ বন্ধ করে দেয়।
রানি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার ডাকে, ডাক্তার এসে খালিদকে মৃত বলে। খালিদ পৃথিবীর দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পায়। কয়েকমাস পর লতিফ সাহেব বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যায়। সাবিহার খবর আর রাখেনা। একদিন সাবিহা নিজেই ফোন দেয়।
লতিফ : কেমন আছ।
সাবিহা : তুমি তো আজকাল আমাকে ভুলেই গেছ। মন্দ থাকলেই কি আমার খবর নেওয়ার কেউ নেই।
লতিফ : তুমি এখন বুড়ি হয়ে গেছ,তোমার রুপ যৌবন আর নেই। এখানে অনেক সুন্দরি সুন্দরি ডার্লিং আছে। তোমাকে এখন খুব বাজে লাগে। সাবিহা আর সহ্য করতে না পেরে কল কেটে দেয়। সাবিহার আজ নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে, মনে মনে ভাবছে খালিদকে কত কষ্টই দিয়েছি, তবু মানুষটা বিরক্ত হয়নি কোনদিন টুঁশব্দ পর্যন্ত করেনি, উল্টো আমাকে সুখে রাখার জন্য কতকিছু করেছে। সাবিহার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো অবিরাম ধারায়। অভাগা মন বুঝলে অসময়ে যখন ক্ষমা চাওয়ার সু্যোগও হারিয়েছে। ২বছর হলো সাবিহা চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে।
সাবিহা : কোথায় যাচ্ছিস।
আবিদ : যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবো তোমার কি।
সাবিহা : (দরজার সামনে দাঁড়ালো) ড্রিংক করে নিজেকে শেষ করিসনা বাবা। আবিদ সাবিহাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে চলে যায়।
সাবিহা : উ—–হ ইভা সব দেখেও সাবিহার কাছে আসেনা। সাবিহার সামনে দিয়ে পার্টিতে চলে যায়। সাবিহা কপালে হাত দেয়, রক্তে তার হাত লাল হয়ে যায়। সাবিহার আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী নিঃস্ব মনে হচ্ছে। খালিদের কথা মনে হয়, বুঝতে পারে জীবনে কাউকে কষ্ট দিয়ে, কারো সাথে প্রতারণা করে কেউ সুখী হতে পারেনা। সাবিহার চোখের জল শেষ হয়না, নিজের কর্মের অনুশোচনা করে মনেমনে। সময়ের ভুল সময়েই শুধরাইতে হয়, অসময়ে বুঝা নিরর্থক। – সমাপ্ত –
গল্পের নাম: হৃদয়ে রক্তক্ষরণ
লিখেছেন : কবি সাদিয়া সুলতানা নীলু
বি:দ্র:- সমাজে নির্যাতিত নারীদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে অনেক পুরুষ।নির্যাতিত পুরুষের কাহিনী আমরা জানিনা,কারণ তারা নারীদের মতো সহজেই কাঁদতে পারেনা,নিজের নির্যাতনের কাহিনী সহজেই বলতে পারেনা আত্নসম্মানের ভয়ে।তাদের নির্যাতিত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ বুঝেনা।জীবন থেমে থাকেনা শেষ হয়,যৌবনেরও শেষ হয়,শুধু যৌবনে,জীবনে করা পাপগুলো লিপিবদ্ধ থাকে।মৃত্যু পার্থিব জীবনের শেষ,কিন্তু আখিরাতের জীবনের সূচনা মাত্র,সে জীবন অনন্তকালের।তাই পার্থিব জীবনের সামান্য সুখ যেন অনন্তকালের দুঃখের কারন না হয়,সেদিকে লক্ষ রেখে আমাদের জীবন পরিচালনা করা উচিত।কর্মের ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়।কাউকে দেওয়া কষ্টের প্রতিফলএকদিন নিজেকে কোন না কোনভাবে গ্রাস করে।]