গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে একদল বিপথগামী তরুণের আত্মঘাতী হামলায় অনেকটাই বদলে দেয় বাংলাদেশকে। ৪ বছর আগে সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়া ওই ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশ।
তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়।
হামলার পেছনে ছিল জঙ্গিদের তিন উদ্দেশ্য
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের। ১. কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; ২. বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং ৩. দেশে বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩ ডিসেম্বর মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের জবানবন্দি নেওয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সবশেষ সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
সাক্ষ্যে তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে।
নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে ওই হামলার পরিকল্পনা করে জানিয়ে পরিদর্শক হুমায়ুন বলেন, “তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো।”
জঙ্গিবাদমুক্ত দেশ গড়তে সর্বপ্রথমে ধর্মান্ধতা দূর করতে হবে
জঙ্গিবাদমুক্ত দেশ গড়তে হলে সর্বপ্রথম ধর্মান্ধতা দূর করার তাগিদ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ধর্মান্ধতা দূর করতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর যে গণ্ডগোল রয়েছে তা বের করতে হবে। আমরা দেখেছি যতোগুলো জঙ্গি এসেছে নিজেদেরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।সেটি মাদ্রাসাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় হোক, কিংবা স্কুলই হোক। তার মানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে কোনো ধরণের গণ্ডগোল আছে, অর্থাৎ এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার মতার্দশ ছড়ানোর একটি অবকাশ বা একটি ক্ষেত্র রয়ে গেছে। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর খুব বেশি দিতে হবে, যাতে কচি মনের বাচ্চাগুলো কোনমতেই হিংসার মতার্দশে আদিষ্ট না হয়। এবং যারা আদিষ্ট করেন তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।’
ধর্মান্ধতার দূর করতে হলে কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তিনি বলেন: ধর্মের ভেতর জঙ্গিবাদ, ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, যা হচ্ছে সেটিকে আলাদা করতে হবে। জঙ্গিবাদ ধর্ম নয়, এটি করার জন্য আমাদের সমাজে যেহেতু ধর্মভীরু সমাজ, সেহেতু এখানে যারা ধর্ম প্রচার করেন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, যদিও সে ভূমিকা তারা উল্টো দিকে পালন করেন বেশি।তাদেরকে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে হিংসার মতার্দশ কেউ যেন ধর্মের নামে না ছড়ায়।তাই এখানে একটি পরিকল্পনা দরকার।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়েছে
গত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবাদ বিরোধী নানা ধরনের তৎপরতায় মানুষের মধ্যে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সাধারণ মানুষের এমন তৎপরতার ফলে জঙ্গিরাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কারণ জঙ্গিরা ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য নিরাপদ আস্তানা খুঁজে পাচ্ছে না। ভাড়াটিয়া হিসেবে নতুন কেউ আসলে তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র সংগ্রহ করে নিকটস্থ থানায় জমা দিচ্ছেন বাড়ির মালিকরা।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নানান প্রতিবন্ধকতার পরও জঙ্গিরা অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নানান রকম প্রলোভনের মাধ্যমে তরুণদের তাদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ভার্চ্যুয়াল জগতে নজরদারি অব্যাহত আছে। প্রায়ই এমন অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। বিচারিক কার্য্ক্রম শুরুর এক বছরের মধ্যেই গত ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ে মামলার ৮ আসামির ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যা শ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
সিটিটিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, প্রায় দেড় বছর আগে পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে নৃশংস এ হামলা সরাসরি বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতি পাঁচ জঙ্গিকে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবির একটি গ্রুপ বিদেশিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরবর্তীতে ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ গ্রুপটির কথিত শুরারকমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেয়।