রাজশাহী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐত্যিহবাহী মেট্রোপলিটন শহর। এটি উত্তরবঙ্গের সবথেকে বড় শহর। রাজশাহী শহর পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। যা রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় শহর। রাজশাহী শহরের নিকটে প্রাচীন বাংলার বেশ কয়েকটি রাজধানী শহর অবস্থিত। এদের মাঝে লক্ষণৌতি বা লক্ষনাবতি, মহাস্থানগড় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী তার আকর্ষণীয় রেশমীবস্ত্র, আম, লিচু এবং মিষ্টান্নসামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে রেশমনগরী নামে ডাকা হয়। রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের অনেকগুলোর খ্যাতি দেশের গণ্ডি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নামকরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য রাজশাহী শহর শিক্ষানগরী নামেও পরিচিত। রাজশাহী শহরে এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয় তথা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। শহরটি নওহাটা এবং কাটাখালী এ দুটি স্যাটেলাইট টাউন বা উপগ্রহ শহর দ্বারা বেষ্টিত। এ দুটি শহর এবং রাজশাহী শহর একসাথে প্রায় ১ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি মহানগর এলাকায় পরিণত হয়েছে। রাজশাহী বাংলাদেশের শহরগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন এবং সবুজ।
ইতিহাস
রাজশাহী সুপ্রাচীন ঐতিহ্য মণ্ডিত একটি শহর। অনেক আগে থেকে এই শহরটি প্রাচীন বাংলায় পরিচিত ছিল।
প্রাচীন ও মধ্যযুগ
রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার পুন্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের সময়ের রাজধানী বর্তমান রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ছিল। মধ্যযুগে বর্তমান রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর বোয়ালিয়া নামে। এর সূত্র ধরে এখনও রাজশাহী শহরের একটি থানার নাম বোয়ালিয়া।
আধুনিক যুগ
রাজশাহী শহরকে কেন্দ্র করে ১৭৭২ সালে জেলা গঠন করা হয়। ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় রাজশাহী পৌরসভা। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়।
ব্রিটিশ রাজত্বের সময়েও রাজশাহী বোয়ালিয়া নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম অঞ্চলের অর্ন্তগত রাজশাহী জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র। রাজশাহীকে সে সময়ে রেশম চাষের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। তখন রাজশাহীতে একটি সরকারী কলেজ ও রেশম শিল্পের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সেসময় থেকে দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত পদ্মা নদীর উপর দিয়ে প্রতিদিন যাত্রীবাহী স্টিমার চলাচল করত।
১২ জুন ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজশাহী শহরের বেশীরভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে অনেক ভবন আবার নতুন করে স্থাপিত হয়।
রাজশাহী শহরটি দীর্ঘদিন ধরে পুরনো সংস্কৃতি বজায় রেখে এক প্রকার অপরিবর্তিত অবস্থায় ছিলো । কিন্তু প্রাচীন এই শহরটি আধুনিকতার পরশে নতুন রুপে সজ্জিত হয় ২০০৯ সালের পর থেকে । জনাব খাইরুজ্জামান লিটন যখন রাজশাহীর মেয়র পদে অধিষ্ট হন তখন দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে শুরু করে। ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মার পাড়কে সংস্কার করে পার্কের রুপ দান করেন । যেখানে শহরের বাসিন্দারা বিকেলে পরিবারের সবার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে পারেন । আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে পদ্মার ধারে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধাও দেওয়া হয় তার প্রচেষ্টায় ।
রাজশাহীর তথ্য ও প্রযুক্তি
রাজশাহীতে এখন প্রায় ১৫টি সফটওয়ার ফার্ম আছে। তাছাড়া এখানে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রায় ১০টি ট্রেনিং সেন্টার আছে; যা দিন দিন বাড়ছে। এখানে বড় দুইটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় আইটির লোকবলের কোন অভাব নেই।
মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহী তথা সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইনের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সাথে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। এ সকল ঘটনা সমূহ জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রামী জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তোলে। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। রাজশাহী পুলিশ লাইন সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মনের মধ্যে কাজ করেছিল। এ সকল কারণে আগে থেকেই রাজশাহী পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। কয়েকটি বাংকারও তৈরি করা হয়।
নগর প্রশাসন
রাজশাহী মহানগর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন যা রাসিক নামে পরিচিত। রাজশাহী মহানগরকে রাসিক এর আওতায় ৩০ টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য স্থাপনা
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাদুঘর হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এটি উদ্বোধন করেন। বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর স্থাপত্যশিল্পের বিশাল সম্ভার রয়েছে এই বরেন্দ্র যাদুঘরে। এই জাদুঘর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। প্রতিদিন প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন দেখতে কয়েকশ’ দর্শনার্থী আসেন এখানে। ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এই জাদুঘর পরিচালনা করে আসছে। শনিবার থেকে বুধবার ১০টা থেকে সাড়ে ৫ টা এবং শুধু মাত্র শুক্রবার জাদুঘর দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। বর্তমানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয় এই যাদুঘরে যার মূল্য ৫ টাকা।
গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সমূহঃ
গ্রেটার রোড, শেরশাহ্ রোড, কাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গির রোড, স্টেশন রোড, কাজী নজরুল ইসলাম স্বরণী, বিমান-বন্দর রোড, বেগম রোকেয়া রোড, দোশর মন্ডল রোড, রাণীবাজার-টিকাপাড়া রোড, সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট-নিউমার্কেট নতুন সড়ক, তালাইমারি রোড, টিবি রোড, রাজশাহী সিটি বাইপাস সড়ক, আলিফ লাম মিম ভাটা-বাইপাস সড়ক, ক্যান্টনম্যান্ট রোড, টিটিসি রোড, প্যারা মেডিকেল রোড, মহিলা কলেজ রোড, সিএনবি রোড, পুরাতন নাটোর রোড, মালোপাড়া-রাণীবাজার ভায়া সষ্টিতলা কানেকটিং রোড, ভদ্রা-কামরুজ্জামান চত্বর রোড, এছাড়াও আরো রাস্তা রয়েছে। উপরে উল্লেখিতত রাস্তা সমূহ ৪ লেন ও মাঝখানে ডিভাইডার রয়েছে।
রেলওয়ে যোগাযোগ
রাজশাহী -ঢাকা, খুলনা, রংপুর, চিলাহাটি, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া,পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, বগুড়া, সৈয়দপুরে প্রতিদিন আন্তঃনগর, লোকাল, মেইল ট্রেন চলে।
রাজশাহী শহরে ৩ টি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে- রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন, ও কোর্ট স্টেশন।
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান
রাজশাহী শহর শিক্ষা নগরী হিসাবে পরিচিত। দেশের বেশ কিছু নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই শহরে অবস্থিত।