রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনে করোনা আইসোলেশন সেন্টারে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছে পুলিশের তদন্ত কমিটি৷ রিপোর্টে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার কারণেই রোগীদের মৃত্যু হয়েছে৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে৷ সেখানে বলা হয়েছে, ওই হাসপাতালের একটি রুম এবং বাইরে সংলগ্ন এলাকায় তাবু দিয়ে আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছিল৷ রুমে পাঁচটি বেডে ছিলেন পাঁচজন রোগী আর বারান্দার তাবুতে বসতেন চিকিৎসক ও নার্সরা৷ তাবুর এসিতে ‘স্পার্ক’ হয়ে আগুন লাগে৷ এতে এসির নীচে একটি বেডেও আগুন লাগে৷ সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ আগুন লাগার পর চিকিৎসক ও নার্স থাকলেও তারা বের হয়ে যান৷ কেউ রোগীদের রক্ষার চেষ্টা করেননি৷ সেখানে ছিল না আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা৷
গত ২৭ মে রাতে গুলশানে বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে নির্মিত করোনা ইউনিটে আগুন লাগে৷ আর সেই আগুনে সেখানে চিকিৎসাধীন পাঁচজন রোগীই মারা যান৷
‘‘তাবুতে একজন ডাক্তার ও দুইজন নার্স ছিলেন৷ কিন্তু আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার চলে যান৷ এরপর নার্সরাও চলে যান,’’ বলেন তদন্তের সুপারভাইজিং কর্মকর্তা গুলশান জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী৷
‘‘একজন ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত শুধু তার ফ্লোর পরিষ্কার করার ‘মপ’ দিয়ে এসির আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন৷ এসি আগুনে গলে গলে বেডের উপর পড়লে সে তা সরানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু ভেতরের রুমে পাঁচ জন রোগীকে বের করে আনা বা উদ্ধারে কেউই কোনও চেষ্টা করেনি,’’ যোগ করেন তিনি৷
কর্তৃপক্ষের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুন লাগার দুই আড়াই মিনিটের মধ্যে তাবু ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ রোগীদের কক্ষেও সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে৷ এই ধোঁয়া হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী৷ কারণ সেখানে এসি পুড়ছিল, স্যানিটাইজার ছিল, অনেক ধরনের দাহ্য ও ধাতব পদার্থ ছিল৷ আর এই গ্যাসেই পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে৷
করোনা আইসোলেশন সেন্টারে আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না৷ এমনকি ছিল না অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার, যা থাকলে আগুন নেভানো সম্ভব হতো৷ কোনও ফায়ার হাইড্রেন্ট, হোস পাইপ, বালতি বা বালুও ছিল না৷ ছিল না হাসপাতালের কোনও অগ্নি নির্বাপক দলও৷
ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন সেন্টার এবং মূল ভবনের বাইরে যে তাবু নির্মাণ করা হয় তারও কোনও অনুমোদন নেওয়া হয়নি৷
করোনা আইসোলেশন সেন্টারে আগুন লাগে রাত ৯টা ২০ মিনিটে৷ ফায়ার সার্ভিস খবর পায় আরও ৩৫ মিনিট পর৷ তারা ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসে৷ রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে৷ এরপর তারা পাঁচ রোগীর মৃতদেহ উদ্ধার করে৷
সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ফায়ার সার্ভিস আসার আগে আগুন নেভানো বা ওই পাঁচজন রোগীকে উদ্ধারের কোনও চেষ্টাই করা হয়নি৷ আমরা এই ঘটনায় চরম দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার প্রমাণ পেয়েছি, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷’’
‘ফায়ার সার্ভিসেকেও অন্য রোগীরা খবর দিয়েছেন’
ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে আগুন লাগার সময় সেখানে ছিলেন ওই সেন্টারে ভর্তি রোগী ভেরন অ্যান্থনী পলের (৭৪) মেয়ে জামাই রোনাল্ড নিকি গোমেজ৷ তিনি সেন্টারের বাইরে ছিলেন৷ ওইদিনই বিকালে পরীক্ষায় তার শ্বশুরের করোনা নেগেটিভ আসায় তাকে করোনা সেন্টার থেকে হাসপাতালের বেডে নেওয়া বা ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল৷ সেজন্যই তিনি গিয়েছিলেন৷ কিন্তু মূল ডাক্তার না থাকায় তিনি অপেক্ষা করছিলেন৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার সামনেই আগুন লাগে৷ কিন্তু কেউ রোগীদের উদ্ধার বা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি৷ আমি বারবার হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি৷ এমনকি ফায়ার সার্ভিসেকেও হাসপাতালের অন্য রোগীরা খবর দিয়েছেন৷ আমি চেষ্টা করেও আমার শ্বশুরকে বাঁচাতে পারিনি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পাঁচজন রোগী হাসাপতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায়ই মারা গেছেন৷’’ এ কারণে তিনি গুলশান থানায় ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন৷ মামলায় ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, চিকিৎসক, নার্স ও করোনা ইউনিটের অন্য কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে৷
ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ এখন চুপ
তবে এই তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ইউনাইটেড হাসপাতালের যোগাযোগ ও ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডা. শাগুফা আনোয়ার৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন যেহেতু বিষয়টি একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাই কোনও মন্তব্য করতে চাই না৷ বিষয়টি আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার দেখছেন৷’’
কিন্তু আগুনে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর পর তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের কোনও অবহেলা নেই দাবি করে বলেছিলেন, ‘‘আমরা রোগীদের বাঁচাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছি৷’’