এক যে ছিল এক কৃষক। তার নাম ছিল নজর আলী। নামের সাথে তার কাজের এত মিল ছিল যে পাড়ার সকলেই তাকে দেখে ভয়ে পালাতো তার নজর থেকে বাঁচতে। একবার হলো কি নজর আলী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, রাস্তার পাশে ছিল একটা বিশাল পুকুর। পুকুরে ছিল নানারকমের মাছ। পুকুরের মালিক জেলেকে দিয়ে অনেক মাছ ধরলো বিক্রি করার জন্য। মাছগুলো বেচারা নজর আলীর নজর কাড়লো। সে বললো, আহা! কি সুন্দর মাছ। বলেই সে চলে গেল। সেই রাত থেকে পুকুরের মাছ মরা শুরু করলো। পরেরদিন সকালবেলা পুকুরের মালিক পুকুর পাড়ে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। হায় কে আমার সর্বনাশ করলো, এ নিশ্চয় নজর আলীর কাজ। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তিনদিনের মধ্যে পুকুরের সব মাছ মরে শেষ হল। পঁচা মাছের গন্ধে রাস্তার লোকের চলাচল কষ্টকর হয়ে পড়লো।
একবার নজর আলী এক গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সেই গোয়াল ঘরে লোকজনের কোলাহল শুনে সে উঁকি দিয়ে দেখল একটি গাভী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে। গাভীকে দেখা মাত্রই নজর আলীর মনে অস্থিরতা শুরু হলো। আর অমনি নজর লাগিয়ে দিল। এদিকে গাভীর অবস্থা আরও খারাপ হল, গাভী যন্ত্রণায় ছটফট করছে, সারারাত এভাবেই কেটে গেল, কিছুতেই কিছু হল না, গাভীর মালিকতো চিন্তায় অস্থির। হঠাৎ তার স্ত্রী বললো, নজর আলী সন্ধ্যায় এসেছিল, এটা ঔ পাজীটার কাজ। তাড়াতাড়ি যাও ঐ বেটা ইবলিসের কাছ থেকে পানি পড়ে নিয়ে আস, নইলে আমাদের গাভী মারা যাবে। গাভীর মালিক তাড়াতাড়ি নজর আলীর বাড়িতে গেল। তাকে দেখেই নজর আলী বুঝতে পারলো ঘটনা কি। তাই সে পালানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু লাভ হলো না। গাভীর মালিক তাকে টেনে তার বাড়িতে নিয়ে আসলো। গোয়াল ঘরে তাকে নিয়ে বললো পানি পড়ে দাও, আমার গাভীর কিছু হলে তোমাকে ছাড়বো না। নজর আলী কোন উপায় না দেখে অবশেষে পানি পড়ে গাভীকে দিতেই, গাভীর একটা ফুটফুটে বাচ্চা হলো।
আরেকবার হলো কি এক নববধূ আর বর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, নজর আলী তাদের দেখেই বললো দুজনকেতো বেশ মানিয়েছে, একেবারে মানিকজোড়। সেইদিন বাড়িতে গিয়ে বর আর বধূর সে কি জ্বর। বেশ কিছুদিন অসুখে ভোগার পরে অসুখ ভালো হয় নজর আলীর পড়া পানি খেয়ে। এভাবেই নজর আলী নজর দিয়ে আশেপাশের সব লোকের ক্ষতি করে চলছে। তারপর একদিন নজর আলী বাজারে যাচ্ছিল হঠাৎ চোখ পড়লো এক কাঁঠাল গাছে, কাঁঠাল গাছে ছিল অনেক বড় বড় কাঁঠাল। কাঁঠাল দেখেই নজর আলী তার বড় বড় চোখে বদ নজর লাগালো। ফলে সেই গাছের সব কাঁঠাল পঁচে পড়তে লাগলো। একটা কাঁঠালও ভালো থাকলোনা। তারপর একবার বিয়ের দাওয়াত খেতে গেল নজর আলী, বিয়ে বাড়ির উঠানের একপাশে ছিল একটি পেঁপে গাছ, গাছে অনেক পেঁপে ছিল, পেঁপেগুলি দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল। নজর আলীর নজর পড়লো পেঁপে গাছে আর পরের দিনই গাছের সব পেঁপে ঝরে পড়ে গেল। নজর আলীর পাশের বাড়ির ছোট্ট ভাতিজা লেখাপড়া করছিল, নজর আলী পড়ার শব্দ শুনে বাড়ির ভিতরে গিয়ে ভাতিজাকে বললো তুমি তো অনেক মেধাবী। যেই না বলা সেই কাজ, ছেলেটি লেখাপড়ায় আর মনযোগী হচ্ছেনা। তখন হঠাৎ ছেলেটির বাবার মনে হল নজর আলীর কথা, তখনি নজর আলীর কাছ থেকে জোড় করে পানি পড়ে নিয়ে আসলো, ছেলেকে খাওয়ালো ফলে ছেলেটির লেখাপড়ায় মনযোগ ফিরে আসলো।
এসএসসি পরীক্ষা শুরু হল। নজর আলী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তার দুরসম্পর্কের ভাতিজা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল, নজর আলীর বদ নজর পড়লো তার উপর। ছেলেটি মেধাবী ছাত্র ছিল, নির্বাচনী পরীক্ষায়ও অনেক ভালো ফলাফল করেছিল। কিন্তু নজর আলীর নজর তাকেও গ্রাস করলো। সে এস.এস.সি তে ফেল করলো। এমনিভাবেই পাড়ার লোকের ক্ষতি করাই ছিল নজর আলীর প্রধান কাজ। তথাপি নজর আলীর একটা ভালো গুন ছিল, সে নিজের স্বার্থ খুবই বুঝতো, তাই সে নিজের পরিবারের কাউকে কখনওই নজর দিত না। নজর আলীর অত্যাচারে পাড়ার লোক অতিষ্ঠ হয়ে গেল। তাকে দেখলেই মাশআল্লাহ, মাশআল্লাহ বলে যথাসাধ্য পালাতে চাইতো, সম্ভব হলে পালাতো। কিন্তু এতে নির্লজ্জ নজর আলীর কিছু যায় আসেনা। সে মানুষের ক্ষতি করে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে। সমাজে এমন কিছু নজর আলী আছে যাদের ছোবল থেকে সমাজের মানুষ মুক্তি চায়। সমাজের মানুষ জানেনা কভূ এদের ছোবল থেকে মুক্তি পাবে কিনা।-(সমাপ্ত)
বি:দ্র:- এটি একটি গল্প হলেও বাস্তবে এমন অনেক নজর আলী আছে, যারা অন্যের ভালো কিছু দেখলেই হিংসা করে, বিভিন্ন ভাবে মানুষের ক্ষতি করে। যদি সমাজ এসব নজর আলী থেকে মুক্তি পায়, সব নজর আলীরা ভালো হয়ে যায়, তবেই পরিবার, সমাজ, দেশ, পৃথিবী সব শান্তিতে ভরে যাবে। এ গল্পের মাধ্যমে সমাজের নজর আলীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, হিংসা ভুলে ভালো হন, মিলেমিশে শান্তিময় সমাজ গড়ুন।
লেখক- কবি সাদিয়া সুলতানা নীলু