টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ঘোষপাড়া এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে ব্যাটারি পুড়িয়ে একটি অবৈধ সীসা তৈরির কারখানা। এখানে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রকাশ্যেই পুরাতন ব্যাটারি ভেঙে পুড়িয়ে সীসা তৈরি করা হচ্ছে।
এছাড়াও এই কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে। পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো: মাহবুবুল হক এর মতে, এ ধরনের উন্মুক্ত স্থানে সীসা পোড়ানোর ফলে জীব-বৈচিত্র্য ও মানুষের খাদ্য চক্রে ঢুকে পড়ছে ভারী ও অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ সীসা। এভাবে ব্যাটারি ভাঙ্গা এবং সীসা গলানোর সময় ক্ষুদ্রকণা বাতাসে ও মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। যার নেতি বাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার কাতুলী ইউনিয়নের ঘোষপাড়া (এসডিএস ব্রিজ সংলগ্ন) এলাকায় পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। দশ জন শ্রমিক ও কর্মচারী পুরাতন ব্যাটারি ভেঙে প্লেট আলাদা করছে। ব্যাটারির পরিত্যক্ত অংশ আলাদা করে রাখা হয়েছে যত্রতত্র। এই দশজন শ্রমিক খালি গায়ে ও খালি হাতে কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই তারা দিনরাত এই কাজ করে যাচ্ছে এই কারখানায়।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানে কোন সাইনবোর্ড, ট্রেড লাইসেন্স, কলকারখানা অধিদপ্তর এর সার্টিফিকেট, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির নিরাপদ চুল্লি নেই। ফ্যাক্টরির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পরিত্যক্ত ব্যাটারির বর্জ্য প্লাস্টিক, কার্বন ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের পদার্থ। টাঙ্গাইলে একটি বেসরকারী পলিটেকনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম লাগানো একটি হাফ টনী পিক-আপে কারখানায় উৎপাদিত প্রায় ১২০ কেজি সীসা তোলা হচ্ছে ঢাকায় চায়না ফ্যাক্টরিতে পাঠানোর জন্য।
কারখানার কর্মচারী শাহাদাৎ জানান, তিনি সহ মোট দশজন কর্মচারী উত্তরবঙ্গ থেকে এখানে এসেছেন কাজ করতে। মালিকের নির্দেশেই তারা এভাবে ব্যাটারি ভেঙ্গে তা পুড়িয়ে সীসা তৈরি করছেন। মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও পেটের দায়ে এই কাজ করছেন তারা।
তিনি আরও জানান, দিনের বেলায় ব্যাটারি ভাঙ্গা হয় আর রাত দশটার পর থেকে তা পুড়িয়ে সীসা তৈরি করা হয়। তাদের ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরি করার কোন চুল্লি নেই। তাই বাধ্য হয়েই উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানান, ব্যাটারি কারখানার মালিক দু’জন টাঙ্গাইলের ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতার নিকট আত্মীয়। ফলে এলাকাবাসীর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই দীর্ঘদিন ধরে এই কারখানাটির চালাচ্ছে। বিশেষ করে রাতে যখন ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরি করা হয় তখন এলাকাবাসীর শ্বাস-প্রশ্বাসে ভীষণ কষ্ট হয়।
তারা আরো জানান, ব্যাটারি পোড়ানোর স্থানে কোন ছাউনি না থাকায় বৃষ্টি হলেই, বৃষ্টির পানির সাথে বিষাক্ত বর্জ্য পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরে ও পাশ্বের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পরে। একসময় ধলেশ্বরী নদীর এই অংশে প্রচুর মাছ পাওয়া গেলেও, কারখানা চালুর পর থেকেই এখানে কোন ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন মিয়া প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে জানান, আপনারা খুব ভালো করেই জানেন এই কারখানাটির মালিক কারা। স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের চাপ থাকা স্বত্তেও কারখানাটির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এমনকি ব্যবসা পরিচালনার জন্য এই কারখানায় মালিক ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন ট্রেড লাইসেন্সও গ্রহণ করেনি। তিনি ফ্যাক্টরি বন্ধে নিজের অসহায়েত্বের কথা স্বীকার করেন।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দীন জানান, এই অবৈধ ফ্যাক্টরির বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে এভাবে প্রকাশ্যে জায়গায় ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরি করলে বায়ু দূষণ ও আশে পাশে বসবাসরত প্রাণীর মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ইতিমধ্যে দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নে একটি অবৈধ ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির কারখানা উচ্ছেদ করেছেন।
তিনি আরও জানান, যত দ্রুত সম্ভব এই অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতা কামনা করেন তিনি।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রানুয়ারা খাতুন জানান, তিনি বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ফেসবুক লাইভে এই অবৈধ কারখানার বিষয়ে জেনেছেন। যত দ্রুত সম্ভব এই অবৈধ কারখানা উচ্ছেদে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরি করা প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভারমেন্টাল সায়েন্স এন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড মো: মাহবুবুল হক লাইভ নিউজ টাঙ্গাইলের প্রতিবেদক কে বলেন, সীসা একটি ভারী ও নিউরো টক্সিক পদার্থ যা মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্ক, কিডনি ও লিভারে বিশেষ ক্ষতি সাধন করে। উন্মুক্ত স্থানে সীসা পোড়ানোর ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। এই নীতিমালার অধীনে সীসা উৎপাদন ও বিপননে কঠোর তদারকি দরকার। উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি পোড়ানোর ফলে এই ভারী ও বিষাক্ত পদার্থ সীসা আমাদের খাদ্য চক্র ও জীবন চক্রে ঢুকে পড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ ব্যাপারে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
উল্লেখ্য,জানা গেছে,দীর্ঘ সময় ধরে পুরনো ও পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে সীসা আহরণ কারখানাগুলো দেশে নিদারুণ দূষণ ও প্রাণহানি ঘটিয়ে চলেছে। এসব কারখানা গড়ে উঠছে দেশের সর্বত্র, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। মানছে না বিদ্যমান পরিবেশ আইন। জনস্বাস্থ্য, প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র তছনছ করে দিচ্ছে। শালবন থেকে হাওর, পাহাড় থেকে নদী অববাহিকা, কৃষিজমি থেকে বন্দর নানা স্থানে গড়ে ওঠা এসব ব্যাটারি কারখানার মাধ্যমে মানুষসহ প্রাণীর শরীরে ঢুকছে সীসার বিষ, প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ঘটছে গোলমাল। সব ব্যাটারি কারখানাই গড়ে উঠেছে বসতি এলাকায়।