জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফিজুর রহমান বাবুল লিখিত বক্তব্য বলেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুডিগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় নানার বাড়ীতে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মো: মকবুল হোসেন। মাতার নাম মজিদা খাতুন। পিতা মকবুল হোসেন প্রখ্যাত আইনজীবি ছিলেন।
তাঁর পৈত্রিক নিবাস অবিভক্ত ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমা শহরে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান এবং চার ভাই-এর মধ্যে প্রথম। তাঁর ডাক নাম ছিলো পেয়ারা।
দিনহাটা হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন। সেনাবাহিনীতে চাকুরিকালে তিনি সেনা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চৌকস গল্ফ খেলোয়াড়।বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা ক্রীড়ার উন্নয়নে তাঁর একটি অনন্য কৃতিত্ব।
মেট্রিক পাশের পর দিনহাটা ছেড়ে পল্লীবন্ধু এরশাদ ১৮৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য সব সময়ই ছিলো পাশাপাশি সাহিত্য কর্মেও ছিলো তাঁর একাগ্রতা। ১৯৫০ সালে তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এ পাশ করেন। পরে পল্লীবন্ধু এরশাদ তাঁর পিতার একান্ত ইচ্ছায় এম.এ-তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই সাথে তিনি ল’-তেও ভর্তি হয়েছিলেন। উভয় বিষয়ে তিনি প্রিলিমিনারী পাশ করেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দেবার আগেই তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার হিসাবে যোগ দেন।
১৯৫২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কমিশন লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ময়মনসিংহের স্বনামধন্য খানসাহেব উমেদ আলী সাহেবের কন্যা রওশন আরা ডেইজীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চুয়াডাঙ্গা সেক্টরে তিনি মেজর পদে থেকে একটি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে পালন করেন। ১৯৭১ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে সকল বাঙ্গালী সেনাদের সাথে পাকিস্তানে আটকা পরেন।১৯৭৩ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আটক অবস্হা থেকে ছাড়া পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন তিনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। বাংলাদেশে ফিরে তিনি আবার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৭৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে এনডিসি কোর্স করার জন্য নয়াদিল্লি প্রেরণ করেন। ১৯৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৭৯ সালের ৭ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮৪ সালের ২৪ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। শাসনভার গ্রহণের পর তিনি দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের স্বার্থে ঐতিহাসিক ১৮ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করেন।
১ জানুয়ারি ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং তিনি এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসন লাভ করে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। তখন সংসদে প্রধান বিরোধী দলে থাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিশিক্ত হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৫ দিন পর ঘোষণা দিয়ে সামরিক আইন তুলে নেন। দিনটিকে অর্থাৎ ১০ নভেম্বরকে জাতীয় পার্টি গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে দেশে স্মরণকালের সর্বাধিক উন্নয়ন সাধিত হয়। উন্নয়ন-সমৃদ্ধি-সংস্কার-কর্মসূচীতে তিনি দেশ পরিচালনার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। তাঁর দুটি কালজয়ী স্লোগান হচ্ছে- “৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে-বাংলাদেশ বাঁচবে” এবং “মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান”।
তিনি এক নাগাড়ে প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দেশে অসংখ্য উন্নয়ন, সংস্কারমূলক কর্মকান্ড সাধন করেন। তার মধ্যে যুগান্তকারী কর্মকান্ড হচ্ছে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা ইত্যাদি। উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সংস্কারের বরপুত্র এরশাদ এদেশে এমন কোনো সেক্টর নেই- যেখানে তিনি হাত দিতে পারেননি। তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্লীবন্ধু এরশাদ বিরোধী দলের দাবী মেনে নিয়ে- সাংবিধানিক পন্থায় স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তার নির্দেশ অনুসারে ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং তিনি নিজে ৫টি আসনে জেলে বসে নির্বাচনে প্রার্থী হন। সেই নির্বাচনে কোনো প্রচার ছাড়াই জেলে থেকে তিনি ৫টি আসনেই বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে দেশবাসী তথা গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তৎকালীন বিএনপি সরকার তাঁকে ৫ বছরের মেয়াদের মধ্যে একবারের জন্যেও সংসদে বসার সুযোগ দেয়নি। উপরন্তু বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা দায়ের করতে থাকে। সব মিলিয়ে বিএনপি সরকার পল্লীবন্ধু এরশাদের নামে ৪২টি মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করে।
১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে জেলে থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করতে হয়। এই নির্বাচনেও তিনি জেলে থেকে ৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এই নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে ২২ বছর পর তাদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দেন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগার থেকে মুকতি লাভ করেন।