চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বরেণ্য সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব ভাষাসৈনিক কামাল লোহানী। নক্ষত্রখচিত নামটিই বহু বিশেষণের সমাহার। জীবনব্যাপী আলো জ্বালিয়েছেন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাকে সমুন্নত রাখতে, শেষ অবধি সাধারণ মানুষের সঠিক জীবন রূপায়ণে অবিস্মরণীয় অবদানের মধ্য দিয়ে। ক্লান্তিহীন এই মানুষটি নিরন্তর হেঁটেছেন দেশ ও মানুষের নিরবচ্ছিন্ন কল্যাণ অনুসন্ধানের ব্রত নিয়ে। ১৯৩৪ সালে ২৬ জুন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি পৃথিবীর আলো দেখেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সোনতলা গ্রামে। বাবা আবু ইউসূফ মোহাম্মদ মূসা খান লোহানী এবং মা রোকেয়া খান লোহানীর কৃতী সন্তান কামাল লোহানীর শৈশব-কৈশোর কেটেছে নিজ গ্রামে। ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পথযাত্রায় এই লড়াকু মানুষটি নিজেকে শামিল করতে মোটেও ভাবেননি। সরাসরি অংশ নেয়া এই তরুণ ভাষা সংগ্রামীকে সঙ্গত কারণে জেল-জুলুমও পিছু ছাড়েনি। তোয়াক্কা করেননি সেসব। দেশাত্মবোধের অনমনীয় চেতনায় রাজনৈতিক সচেতনতায় একাত্ম হতেও সময় লাগেনি। তৎকালীন উদীয়মান প্রজন্মের বাম ঘরানার প্রতি যে নিবিড় মনোসংযোগ, সেটাও তার মতো দেশপ্রেমিক মানুষকে অনুক্ষণ তাড়িত করেছে। ফলে বাম সংগঠনের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততাকে অনবচ্ছেদ করে সম্মুখ-সমরে ঝাঁপিয়ে পড়তেও কুণ্ঠিত হননি। লড়াকু জীবনের কঠিন যাত্রার পথ কখনও মসৃণ এবং সহজ ছিল না। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সপক্ষে সংগঠিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও ছিলেন। তেমন প্রেক্ষাপটে ‘ছায়ানটের’ মতো সাংস্কৃতিক দ্যোতনার শুরুটাও ছিল তাঁর পুরোধা ব্যক্তিত্বের এক বলিষ্ঠ কর্মযোগ। সে সময় তাকে কারাবন্দীও থাকতে হয়। মুক্ত হওয়ার পর ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের পদটিও অলঙ্কৃত করেন। সফল সংগঠকের অসামান্য কৃতিত্বে জীবনে বহুবার নিজের কর্মদক্ষতায় আপন সীমানা অতিক্রম করতেও তাকে পেছনে কখনও ফিরতে হয়নি। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে শ্যামা নৃত্যনাট্য প্রদর্শিত হলে সেখানে বজ্রসেনের ভূমিকায় অভিনয়ে শিল্পীর পারদর্শিতাও প্রমাণ করেন। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর ছায়ানটের দায়িত্ব পালন করার পর নিজেই আর এক সংগঠন ‘ক্রান্তি’র প্রতিষ্ঠা করেন। এই পুরোধা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উপস্থাপনেও তার সাবলীলতা, সক্ষমতা এবং শৈল্পিক শৌর্যের পরিচয় তুলে ধরেন। দীর্ঘদিন উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পৃক্ততা ও পরিচয়ের বলয়কে দীর্ঘায়িত করতে নিরন্তর এগিয়ে গেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের ঐতিহাসিক ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবেও তার কৃতিত্ব স্মরণ করার মতো। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের আসনটিও অলঙ্কৃত করেন। ১৯৭৩ সালের নতুন প্রকাশিত পত্রিকা ‘জনপদে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাংবাদিকতায় নিজের অকৃত্রিম দায়বোধকে নবউদ্যমে সে জাগিয়ে তোলেন। এর পর ‘বঙ্গবার্তা’, ‘দৈনিক বাংলার বাণী’তেও তার সাংবাদিকতার জগত সমৃদ্ধ হতে থাকে। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয়বার ২০০৮ সালেও তিনি এই ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হন। বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন আপন কৃতিত্বে। ২০১০ সালে বাংলা-একাডেমির সম্মাননা ফেলোশিপ পান এই ভাষা ও মুক্তি সংগ্রামী বরেণ্য যোদ্ধা। ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ‘একুশে পদকে’ তাকে সম্মানিত করা হয়। ২৬ জুন তার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। তার মৃত্যুর শোকের ছায়ায়ও জন্মবর্ষ স্মরণ কোনভাবেই ম্লান হবার নয়। বার্ধক্যজনিত হরেক রকম জটিলতা নিয়ে শেষ অবধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে কামাল লোহানী সবাইকে ছেড়ে চলে যান। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।